জাপায় আবারও ভাঙ্গনের সুর
রওশনের নেতৃত্বে আসতে পারে নতুন জাপা
প্রয়াত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিতে (জাপা) আবারও ভাঙ্গনের দিকে যাচ্ছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর বর্তমান চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে দলের প্রার্থীরা। বৃহস্পতিবার দলটির কেন্দ্রীয় পর্যায়ে প্রায় ৪০ জন নেতা কাকরাইল কার্যালয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে আগামী রোববার পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে নেতাকর্মীদের নিয়ে বসার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই বৈঠক থেকে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে পৃথক জাপা গঠনেরও সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে দলটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
এর আগে দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে গত বুধবার জাপা চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভ করে নেতা-কর্মীরা। শীর্ষ এই নেতার পদত্যাগের আলটিমেটামও দেওয়া হয়। তারা বলেছেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগ না করলে তাদের পদ থেকে সরিয়ে নতুন নেতৃত্ব ঘোষণা করা হবে।
মনোনয়ন বাণিজ্য, প্রার্থীদের খোঁজখবর না নেওয়া, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত না করাসহ বিতর্কিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়ায় শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা। এবারের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিও জাপা থেকে মনোনয়ন পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীরা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। তাদের কাজে লাগিয়ে পরিকল্পিতভাবে বুধবার বনানী কার্যালয়ে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। এর নেপথ্যে রয়েছে সংরক্ষিত কোটায় দলের পক্ষ থেকে নারী সদস্য দেওয়ার বিষয়টি। মূলত জাপার নীতিনির্ধারকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতেই কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা এ কাজটি করিয়েছেন।
নেপথ্যে নেতাদের মধ্যে রয়েছেন জাপার তিনজন কো-চেয়ারম্যান। তাদের মধ্যে দু’জন আগের দিন রাতে দলের অপর কো- চেয়ারম্যানের গুলশানের বাসায় দীর্ঘসময় বৈঠক করেন। এর পরই বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা পার্টিতে নানা বঞ্চনার কথা তুলে ধরে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে সবাইকে বনানী কার্যালয় দখল, বিক্ষোভে অংশ নিতে বলেন।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ২৬ আসনে সমঝোতা হলেও মাত্র ১১টি আসনে বিজয়ী হয়েছেন জাপার প্রার্থীরা। এই হিসাবে জাপা সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি পাবে দুটি। এর মধ্যে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঢাকা-১৮ আসনে পরাজিত প্রার্থী এবং জাপা চেয়ারম্যানের স্ত্রী শেরীফা কাদের অন্যটি ঢাকা-১ আসনের পরাজিত প্রার্থী ও সাবেক এমপি সালমা ইসলামকে দেওয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত করেছেন দলের চেয়ারম্যান। এবারের সংসদে দলের পাওয়া দুই সংরক্ষিত নারী আসনের দাবিদার তিনজন কেন্দ্রীয় নেতার। এরমধ্যে দুই জন স্ত্রীর জন্য। অপরজন মেয়ের জন্য। তাদের কাউকেই সংরক্ষিত আসন দিতে নারাজ জি এম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নু। চাপ সৃষ্টি করে নারী আসনে এমপি আদায় করতেই তিন নেতা প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে দলের বনানী কার্যালয় দখলের চেষ্টা, চেয়ারম্যান-মহাসচিবের পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভে অংশ নেন।
বুধবার বনানী কার্যালয়ের সামনে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলার সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। বৃহস্পতিবার তাদের সুর একেবারেই ভিন্ন। তারা বলছেন, মনোনয়ন বাণিজ্য, প্রার্থীদের খবর না নেওয়াসহ বিতর্কিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়ায় দলের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। এই ক্ষোভ থেকে পরাজিত অনেক প্রার্থী ঢাকায় বিক্ষোভ করেন। কিন্তু বিক্ষোভ মানেই দলের শীর্ষ নেতাদের বাদ দেওয়া, নতুন দল গঠন করার দাবির পক্ষে ছিলেন না তারা কেউ। পাশাপাশি গত তিন মেয়াদে যারা এমপি হয়েছেন, সরকারের নানা পর্যায়ে সুবিধা নিয়েছেন, তাদের বিক্ষোভ করা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। কিংবা বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে কারও কারও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করাকে মেনে নিতে চান না পরাজিত প্রার্থীর অনেকেই।
এদিকে এবারের নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগও বিস্তর। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের ৩৩ আসনেই এ অভিযোগ বেশি। এর কারণ হিসেবে জাপা নেতারা বলছেন, উত্তরের জনপদ জাপার ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এই এলাকার ৩৩ আসনের মধ্যে অনেকগুলোতেই দলের প্রার্থীদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। দলের পক্ষে মনোনয়ন বাণিজ্যের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে একজন প্রেসিডিয়াম সদস্যের বিরুদ্ধে। যিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি আসন থেকে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছেন। যদিও মনোনয়ন বাণিজ্যের বিষয়ে জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, পাবনা-৫ আসনে জেলা জাপার প্রেসিডেন্টকে বাদ দিয়ে তারিকুল আলম স্বাধীনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। কুড়িগ্রাম-৩ আসনে জাপার সাবেক মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুর স্ত্রী ও জাপার প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভাগনে ড. মেহেজেবুন নেছা রহমান টুম্পাকে বাদ দিয়ে আবদুস সোবহানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চারবার জাতীয় পার্টির প্রার্থী এই আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন। বরিশাল-৫ সহ একাধিক আসনে ইকবাল হোসেন তাপসকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এ ছাড়া কুমিল্লা-১১ মোস্তফা কামাল, কক্সবাজার-৩ আসনে অ্যাডভোকেট মো. তারেক মনোনয়ন পান। এসব আসনে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। প্রার্থীদের কেউ সরাসরি গণমাধ্যমের কাছে বিষয়টি স্বীকার না করলেও দলের অনেকের কাছেই অর্থের বিনিময়ে মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেছেন।
মাগুরা-২ আসনে জাপা থেকে মনোনয়ন পাওয়া মো. মুরাদ আলীর বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, দলের বিতর্কিত নেতাদের মনোনয়ন না দেওয়া ও মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধে অনেক কেন্দ্রীয় নেতা শুরু থেকেই দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু তাদের কথা কেউ শোনেননি।
জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু বলেন, ‘চেয়ারম্যান আর মহাসচিব এককভাবে দল পরিচালনা করছেন। তারা কর্মীবান্ধব নেতা নন। তাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি বিকশিত হতে পারে না।
সাবেক এমপি ও দলটির অতিরিক্ত মহাসচিব লিয়াকত হোসেন খোকা বলেন, অযোগ্য নেতৃত্বের কারণে জাতীয় পার্টি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। দলের নেতৃত্ব দেওয়ার অধিকার তাদের নেই।
দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচি মুজিবুল হক চুন্নুর সঙ্গে যোগাযোগ করে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে বুধবার জি এম কাদের পার্টি অফিসে নেতৃত্বের ব্যর্থতা নিয়ে বিক্ষোভ প্রসঙ্গে বলেন, এগুলো সাজানো জিনিস। কিছু লোক আমাদের পার্টিকে প্রশ্নবিদ্ধ অথবা ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করছে। যেটা করা হয়েছে, সবার সঙ্গে আলোচনা করে করা হয়েছে। এ নিয়ে বিক্ষোভ দেখানোর কিছু নেই। আশা করি, সবকিছু স্বাভাবিক হবে